ছুটির দিন। সহধর্মিণীর হাতে বানানো গরম ধূমায়িত এক কাপ। রং চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলাম, আমার সাথে ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনার কথা। ভাবতে থাকি। মনে হলো প্রকৃতি তো কারও কাছে ঋণী থাকে না, যথা সময়ে সবকিছুই ফেরত দিয়ে দেয়। আমেরিকানরাও কারও কাছে ঋণী থাকে না, তারাও তৎক্ষণাৎ সবকিছুই ফেরত দিয়ে দেয়।
বেশ আগের আগের ঘটনা। নতুন বাড়িতে মুভ করেছি। ব্যাচেলর থাকতে দু-একবার বাসা বদল করেছি। তাই বাসা বদল আমার কাছে নতুন কিছু নয়। অতীতের তুলনায় সেইবার বাসা বদল ছিল সহজ। কথায় বলে 'প্রাকটিস মেকস এ ম্যান পারফেক্ট'।
প্রতিবেশীদের বেশিরভাগই আমেরিকান। ছুটির দিন ছিল। বাসা থেকে দুপুর বেলা রাস্তায় আইসক্রিম ট্রাকের গান শুনে বোঝাই গেল আইসক্রিমওয়ালা এসেছে। আইসক্রিম খেতে ভালোবাসেন না, জগতে এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া কঠিন। মন খারাপ হোক বা মন ভালো হোক, আইসক্রিম হতে পারে সব সময়ের সঙ্গী। আমার মেয়ে আইসক্রিমপাগলী। মেয়েটাকে নিয়ে আইসক্রিম কিনতে গিয়েছি। আইসক্রিম বিক্রেতাকে বললাম আমার মেয়েকে একটা আইসক্রিম দিতে। ঠিক একইসময় দেখি আমার বিপরীতদিকের বাড়ির মালিক (এক আমেরিকান অবসরপ্রাপ্ত ) আইসক্রিম কিনছেন। তার সাথে হাই-হ্যালো করে তিনিসহ আইসক্রিমের বিল পরিশোধ করি। তিনি একটু রাগ করলেন আইসক্রিমের বিল পরিশোধ করায়। তাকে বলললাম, ঠিক আছে, আমি এখানে নতুন এসেছি। আপনার সাথে পরিচয় হয়ে খুব ভাল লাগলো।
তাকে বিদায় জানিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি আমেরিকান ভদ্রলোক আমার বাসায়। বললেন, আপনার জন্য নিয়ে এসেছি কয়েকটি ফুলের চারা। আমি বললাম এগুলোর দরকার ছিল না।
ভদ্রলোক বললেন, আপনার কাছে ঋণী হতে চাই না। ঋণী হতে বড্ড বেশি ভয় লাগে। বললেন, ঋণ বা ঋণী থেকে বাঁচার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অত্যধিক আশ্রয় প্রার্থনা করি। যেতে যেতে বলে গেলেন 'বাগান করুণ, বাগানের পেছনে সময় দেন, বাগান করলে স্ট্রেস, মানসিক অশান্তি, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা এগুলো অনেক কমে যায়।
কিছুদিন আগের ভিন্ন ঘটনা। কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরছি। একটা দরকারি কাজ ছিল ম্যানহাটনে। ম্যানহাটনে মিটার পার্কিং রয়েছে, যেখানে ঘণ্টার হার ৪ ডলার। তিন ঘণ্টার জন্য গাড়ি পার্কিং করে একটি অফিস বিল্ডিং প্রবেশ করি। তথ্য ডেস্ক জানতে চাওয়া হলো, আমার কি কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে? আমি বললাম, না অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। বললেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া ভেতরে যাওয়া যাবে না।
পেন্ডামিক অনেক পরিবর্তন এনেছে, অফিস আওয়ার-অফিসের নিয়ম-কানুন ইত্যাদিতে। গাড়িতে চলে আসলাম। মাত্র দশ মিনিট ব্যয় হলো, গাড়ি রাখা তিন ঘণ্টার জন্য। এখন কি করব? হঠাৎ দেখি আমেরিকান এক ভদ্রলোক পার্কিং মিটারের দিকে যাচ্ছেন, গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ভদ্রলোককে বলি, আমার কাছে প্রায় দু-ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মিটার পার্কিং আছে। আপনি নিয়ে নেন, আমার লাগবে না। ভদ্রলোক খুব অবাক আর খুব খুশি হয়ে বললেন, ওয়াও! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভদ্রলোককে বললাম, এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের। বাসায় যাবার জন্য গাড়িতে উঠে বসলাম। হঠাৎ দেখি আমেরিকান ভদ্রলোক গাড়ি ক্লিন করার নতুন এক বক্স তোয়ালে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা আপনার জন্য। বললাম, আমাকে লজ্জিত এবং বিব্রত করবেন না। ভদ্রলোক অবলীলায় বললেন, চলার পথে কোনো না-কোনো সময় আমরা ঋণী কিংবা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু ঋণী এবং ঋণের বোঝা বাড়তে থাকলে আমাদের চলার পথ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাই আপনার কাছে ঋণী হতে চাই না। ঋণী হতে বড্ড বেশি ভয় লাগে।
গাড়ি চালিয়ে কুইন্স ব্রিজের ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ি। ট্রাফিক জ্যামে দুটো ঘটনা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল আসলেই একজন সুস্থ মানুষ সর্বদা সচেষ্ট থাকেন তার ঋণী এবং ঋণের বোঝা ঋণদাতাকে যথা সময়ে ফেরত দিতে।