বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রতি অপেক্ষাকৃত সহনশীল ও উদার রাষ্ট্র হিসেবে কানাডা সুপরিচিত। কানাডার অবস্থারত অভিবাসীদের সামাজিক ও ধর্মীয় আচার, রীতি এবং কৃষ্টির বৈচিত্রময়তা কানাডার মূলধারার সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। সাংস্কৃতিক ধর্মীয় বৈচিত্রময়তায় পরশ নিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর কানাডার নোভাস্কোশিয়া প্রদেশের রাজধানী হালিফ্যাক্স ওয়েস্ট হাইস্কুলের বেলা আর্ট সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে কেরালার বর্ণিল ঐতিহ্যবাহী কৃষিভিত্তিক ধান কাটার বর্ষবরণের ওনাম উৎসব। হালিফ্যাক্সের ওনাম আয়োজক সংগঠনটি হলো সাউথ ইন্ডিয়ান কালচারাল এসোসিয়েশন অব মেরিটাইম (সিকাম)। হ্যালিফ্যাক্সে আয়োজিত এটি ছিল তাদের ৩৬তম সফল ওনাম উৎসব।
ভারতের কেরালা রাজ্যের প্রতিটি মানুষের জীবনে ওনাম জনপ্রিয় বিশেষ কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় উৎসব ও নববর্ষ হিসেবে বিবেচিত এবং উদযাপিত হয়। দেশে ও প্রবাসে অবস্থানরত ভারতের কেরালার সর্বস্তরের
মালয়ালি অধিবাসীরা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে নিজ নিজ সামর্থ অনুসারে ঐতিহ্যের ধারাকে অব্যাহত রেখে উৎসবমুখর পরিবেশে মূলত আগস্ট মাসের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শুরু পর্যন্ত ওনামের বিভিন্ন আয়োজন করেন।
হ্যালিফ্যাক্সে ওনাম উৎসবে উপলক্ষেই সিকাম সংগঠনটি মনোজ্ঞ সাষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আধুনিক, উপমহাদেশের ধ্রুপদী ঘরানার সংষ্কৃতি ও সনাতন হিন্দু ধামের আরাধনার ও আধুনিকতার এক অপূর্ব অনুপম সংমিশ্ৰণ ঘটেছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।
হ্যালিফ্যাক্সে সকাল দশটা থেকে বিকেল প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত ওনাম আয়োজনের বিভিন্ন পরিবেশনার মধ্যে ছিল প্রদীপ জ্বালানো, শুভেচ্ছা বক্তব্য, সেমি ক্লাসিকাল নৃত্য, ওনামের শুভেচ্ছা ও বিশেষ বক্তব্য, সেমি ক্ল্যাসিকাল নৃত্য, মেডলি নাচ, ফিউশন নাচ, দলীয় সঙ্গীত, ড্রোর প্রাইজ ঘোষণা, দলীয় সঙ্গীত , সিনেমাটিক নৃত্য, শিশুদের দলীয় নাচ এবং তিরুভাত্রিরানৃত্য।
ওনাম উৎসবের ঐতিহ্যবাহী ভোজনরীতি অনুসারে ছাব্বিশ পদ সংবলিত সুস্বাদু ওনামসাধ্যা আহার ছিল। সবুজ কলাপাতায় পরিবেশনের রীতি অনুসারে ওনামসাধ্যা সবুজ কাগজে আহার পরিবেশন করা হয়। ভারতীয় ও উপমহাদেশের রীতি অনুসারে আমন্ত্রিত সবাই হাত দিয়ে গ্রাস তুলে দিয়ে একযোগে খাবার গ্রহণ করেন। হালিফ্যাক্সে ওনাম আয়োজকদের
আন্তরিক বিনম্র প্রচেষ্টায় সুচারুভাবে ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় সমগ্র অনুষ্ঠান।
ওনামের ঐহিত্যবাহী আবহমান রীতি আচার অনুসারে হালিফ্যাক্সের এ অনুষ্ঠানের কেন্দ্ৰ স্থলে পুকলম বা ফুলের পাঁপড়ি দিয়ে অসাধারণ রঙের এক আলপনা নকশা ও বর্ণিল স্টেজ সাজানো হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজক নারী ও শিশুরা সেজেছিলেন সোনালি পাড় ও সাদা শাড়ি দিয়ে, তাদের ওনাম উৎসবের ঐতিহ্যবাহী বসনে।
ভারতের কেরালার রাজ্যের ওনাম উৎসবে শুধুমাত্র সনাতন হিন্ধু ধর্মালম্বীরাই নয়, বরং একটি সার্বজনীন উৎসব হিসেবে বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। হালিফ্যাক্সেও সেদিন এর ব্যতিক্রম হয়নি। মূলধারার ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অতিথি অভ্যাগতদের আগমনে সেদিনের আয়োজনটি একটি ঐতিহ্যবাহী সার্জনীন উৎসবে পরিণত হয়েছিল।
ভারতের কেরালা রাজ্যের ওনামের অপর নাম থ্রু-ওনাম বা থিরুভোনাম ও পরিচিত। জনশ্রুতি ও হিন্দু পুরান অনুসারে, কিংবদন্তির এক চরিত্রে সাহসী অসুররাজা মাভালি বা মহাবলী ঈশ্বরের নির্দেশে অসুরদের চিরায়ত মন্দধারণা পরিবর্তন করে কেরালায় সুখ ও সমৃদ্ধ শালী একটি সুশাসন বজায় রেখেছিলেন। রাজা মহাবলীর আগমন স্মরণে করে এই উৎসবটি উদ্যাপিত হয়। বিশ্বাস করা হয় যে তিনি প্রেতলোকে পতিত হবার আগে শ্রী বিষ্ণু প্রদত্ত বিশেষ বর আশীর্বাদ প্রাপ্ত হন। তাঁর আত্মা
প্রতিবছর ওনামের সময়ে কেরালা পরিভ্ৰমণ করে পৃথিবীতে প্রজাদের খোঁজ নেয়।
এ উৎসবের অন্যান্য আয়োজন হলো, মূলত ধান কাটা ও নুতন ফসল ঘরে তোলা, নৌকা বাইচ বা বল্লম কলি (নৌকা বাইচ), পুলিক্কলি (বাঘ নৃত্য), পূকলম ফুলের আলপনা, ওণতপ্পন বা পূজা), ওণম কলি, রশি টানা, তম্বিতুলল বা মেয়েদের নৃত্য, মুখোশ নৃত্য , ওণতল্লু বা রণকলা, যা এক ধরনের মার্শাল আর্টস, ওণবিল্লু বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো, কজচক্কুল বা উদ্ভিদ উৎসর্গ, বিশেষ সাজ ওণপত্তন, অত্তচ্চময়ম বা লোকনৃত্য ও গীত ইত্যাদি বিভিন্ন আয়োজন করা হয়। এ উৎসব স্থায়ী হয় দশ দিন। কেরালার ওনাম অনুসারীরা উৎসবের ভোরবেলা স্নান সম্পন্ন করেন। বাড়ির বাইরে বিভিন্ন ফুলের পাঁপড়ির বিশেষ আল্পনা তৈরি করে, আর কেরারালায় উৎসবে সবাইমিলে ওনাম সাধ্যা খান।এ উৎসবের প্রথম ও শেষ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। হালিফ্যাক্সের কেরালার অধিবাসী ভারতীয় কানাডিয়ান দম্পতি সুমি মুকুন্দ ও মুকুন্দমোহন এ প্রতিবেদককে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানার ও প্রতিবেদন করার জন্য।